রমজানের ফজিলত রোজা, ইবাদত ও রহমতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
রমজান মাসের ফজিলত, রোজার গুরুত্ব, ইবাদতের তাৎপর্য ও দোয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। কোরআন নাজিলের মাস হিসেবে রমজানের গুরুত্ব অপরিসীম।
রমজান হল ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র মাস, যা মুসলমানদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ মাসে রোজা রাখা ফরজ, যা আত্মসংযম, ধৈর্য এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যম। কোরআন নাজিলের মাস হিসেবে রমজানের মাহাত্ম্য অপরিসীম। এই ব্লগ পোস্টে আমরা রমজানের ফজিলত, ইবাদতের গুরুত্ব, সাওয়াব এবং বিশেষ দোয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
রমজান মাসের পরিচিতি
রমজান মাস ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্য এক মহিমান্বিত মাস। এটি হিজরি বছরের নবম মাস, যা সিয়াম সাধনার মাস হিসেবে পরিচিত। এই মাসে মুসলমানরা সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রোজা পালন করে।
রমজান মাসকে কোরআনে বিশেষ মর্যাদার মাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, কারণ এই মাসেই পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। রোজা মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য এবং সংযম শেখায়। এটি শুধু শারীরিক ত্যাগের বিষয় নয়, বরং আত্মিক ও নৈতিক উন্নতির মাধ্যমও।
এই মাসে বেশি বেশি ইবাদত, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা ও গরিব-দুঃখীদের সহায়তা করা বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়। রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর নামে একটি রাত রয়েছে, যা এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই মাস শেষে আসে ঈদুল ফিতর, যা আনন্দ ও উদযাপনের দিন। রমজান শুধু ধর্মীয় দিক থেকে নয়, স্বাস্থ্যগতভাবেও উপকারী, কারণ এটি দেহকে বিশ্রাম দেয় এবং বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমায়। তাই রমজান মাস শুধু ধর্মীয় উপাসনার মাস নয়, এটি মানবিকতা, সহমর্মিতা ও আত্মশুদ্ধির এক অনন্য সুযোগ।
রমজানের ফজিলত
রমজান মাসের বিশেষ ফজিলত সম্পর্কে পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে বহু বর্ণনা রয়েছে। এই মাসে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য অশেষ রহমত বর্ষণ করেন।
১. কোরআন নাজিলের মাস
রমজান মাসের অন্যতম প্রধান ফজিলত হলো এটি কোরআন নাজিলের মাস। এই মহিমান্বিত মাসেই মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছেন।
কোরআনে বলা হয়েছে, "রমজান মাস, যে মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পথনির্দেশ এবং সত্য-অসত্যের পার্থক্যকারী" (সূরা বাকারা: ১৮৫)। এ কারণে রমজান শুধু রোজা রাখার মাস নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধি, ইবাদত ও আল্লাহর রহমত লাভের শ্রেষ্ঠ সময়।
কোরআনের শিক্ষায় এই মাসে বেশি বেশি ইবাদত করা, দোয়া করা, কোরআন তিলাওয়াত করা এবং দান-সদকা করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদর, যা এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক ফজিলতপূর্ণ।
কোরআন নাজিলের ফলে রমজান মাস আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস হিসেবে বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ। যারা এই মাসে কোরআনের নির্দেশনা অনুসারে জীবন পরিচালনা করে, তারা পরকালীন জীবনে সফলতার আশ্বাস পায়।
রমজান আমাদের আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেয়, আমাদের পাপ মোচন করে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম তৈরি করে। তাই এই মাসকে কেবল রোজা রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, বেশি করে কোরআন পড়া, বুঝা এবং তার শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করা উচিত।
২. জান্নাতের দরজা খোলা হয়
রমজান মাসের অন্যতম ফজিলত হলো, এই মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা হয়। হাদিসে এসেছে, "রমজান মাস শুরু হলে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়" (বুখারি ও মুসলিম)।
এটি বোঝায় যে রমজান মাস আল্লাহর অশেষ রহমতের মাস, যেখানে নেক আমল করা সহজ হয়ে যায় এবং পাপ করার প্রবণতা কমে যায়। যেহেতু এই মাসে শয়তানকে বন্দি রাখা হয়, তাই মানুষ বেশি বেশি ইবাদতে মনোযোগী হতে পারে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে।
জান্নাতের দরজা খোলা থাকার অর্থ হলো, যারা এই মাসে বেশি বেশি ভালো কাজ করবে, আল্লাহ তাদের জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেবেন। এই পবিত্র মাসে রোজা, নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা এবং গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করার মাধ্যমে জান্নাতের পথ প্রশস্ত করা সম্ভব।
রমজান আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য ও তাকওয়া অর্জনের মাস, যা মানুষকে জান্নাতের উপযুক্ত করে তোলে। তাই আমাদের উচিত, এই মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং জান্নাতের পথে এগিয়ে যাওয়া।
৩. শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়
রমজান মাসের অন্যতম বড় ফজিলত হলো, এই মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, "যখন রমজান আসে, তখন জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়" (বুখারি ও মুসলিম)।
এর অর্থ হলো, এই মাসে শয়তানের প্রভাব কমে যায় এবং মানুষ সহজেই নেক আমল করার সুযোগ পায়। শয়তান সব সময় মানুষকে গুনাহের পথে পরিচালিত করতে চায়, কিন্তু রমজানে তাদের কার্যক্ষমতা কমে যায়, ফলে মুমিনরা ইবাদত-বন্দেগিতে বেশি মনোযোগী হতে পারে।
এই মাসে আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়, যা অন্য মাসে পাওয়া কঠিন। যদিও মানুষের নিজের নফসও পাপের দিকে প্ররোচিত করতে পারে, তবুও রমজানে শয়তানের বাঁধন থাকার কারণে মানুষ সহজে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে পারে।
তাই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত, নামাজ, দোয়া এবং দান-সদকা করা উচিত। রমজান আমাদের জন্য এক স্বর্ণালি সুযোগ, যখন আমরা শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সহজ করতে পারি। এটি গুনাহ থেকে ফিরে আসার এবং জান্নাতের পথে এগিয়ে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়।
৪. হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাত – লাইলাতুল কদর
রমজান মাসের সর্বোচ্চ ফজিলতপূর্ণ রাত হলো লাইলাতুল কদর, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, "নিশ্চয়ই আমি কদরের রাতে কোরআন নাজিল করেছি। আর তুমি কি জানো, কদরের রাত কী? কদরের রাত হলো এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম" (সূরা আল-কদর: ১-৩)।
অর্থাৎ এই এক রাতের ইবাদত ৮৩ বছরের বেশি সময়ের ইবাদতের সমান সওয়াব অর্জন করে দেয়। এটি রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে একটি, বিশেষ করে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ বা ২৯তম রাতে পাওয়া যায়। এ রাতে ফেরেশতারা পৃথিবীতে নেমে আসে এবং আল্লাহর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়।
রাসুল (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি কদরের রাতে ইবাদত করে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়" (বুখারি ও মুসলিম)। এই রাতে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া, জিকির ও নফল নামাজ পড়া উচিত।
বিশেষ করে, রাসুল (সা.) শেখানো দোয়া "আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা'ফু আন্নি" পড়লে গুনাহ মাফ হওয়ার আশা করা যায়। তাই আমাদের উচিত এই রাতের পূর্ণ ফজিলত অর্জনের জন্য ইবাদতে মনোনিবেশ করা, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং জান্নাতের পথে এগিয়ে যাওয়া।
৫. দোয়া কবুল হয়
রমজান মাসের অন্যতম ফজিলত হলো, এই মাসে দোয়া কবুল হয়। এটি রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস, যেখানে আল্লাহ বান্দার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেন এবং তার প্রার্থনা গ্রহণ করেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন, "আর যখন আমার বান্দারা তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন বলো, আমি তো খুব কাছেই আছি। আমি প্রার্থনাকারীর দোয়া কবুল করি, যখন সে আমাকে ডাকে" (সূরা আল-বাকারা: ১৮৬)।
রোজাদারের জন্য বিশেষভাবে দোয়া কবুলের সুসংবাদ রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, "তিন ব্যক্তির দোয়া কখনো প্রত্যাখ্যান করা হয় না—রোজাদারের দোয়া, ন্যায়বান শাসকের দোয়া এবং মজলুমের দোয়া" (তিরমিজি)। বিশেষ করে ইফতারের সময় ও সেহরির সময় দোয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময়গুলোতে আল্লাহ বান্দার দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন।
এছাড়া, লাইলাতুল কদরের রাতে দোয়া করা হাজার মাসের ইবাদতের সমান সওয়াব এনে দেয়। রমজান আত্মশুদ্ধির মাস, যেখানে মানুষ তার পাপ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে পারে এবং তার জীবনের কল্যাণের জন্য দোয়া করতে পারে। তাই এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমাদের উচিত বেশি বেশি দোয়া করা, ক্ষমা চাওয়া এবং জান্নাতের পথে নিজেদের তৈরি করা। আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তিনি অবশ্যই তার বান্দার ডাকে সাড়া দেন।
রমজানে করণীয় আমল
রমজান মাসে বেশি বেশি ইবাদত, কোরআন তিলাওয়াত, নামাজ আদায়, দান-সদকা এবং তওবা করা উচিত।
১. রোজা রাখা
রমজান মাসে মুসলমানদের প্রধান করণীয় আমল হলো রোজা রাখা। এটি ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি, যা প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের জন্য ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন, "হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো" (সূরা আল-বাকারা: ১৮৩)।
রোজা রাখা মানে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ধরনের খাবার, পানীয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা। এটি শুধুমাত্র ক্ষুধা ও তৃষ্ণা সহ্য করার বিষয় নয়, বরং আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্যের প্রকাশ। রোজা মানুষের ধৈর্য, সংযম এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি বৃদ্ধি করে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় রোজা রাখে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়" (বুখারি ও মুসলিম)। রোজা আমাদের মধ্যে সহমর্মিতা ও দানশীলতার গুণ সৃষ্টি করে, কারণ এটি গরিব-দুঃখীদের কষ্ট অনুভব করার সুযোগ দেয়।
এটি শরীরের জন্যও উপকারী, কারণ এটি বিপাকক্রিয়া উন্নত করে এবং অপ্রয়োজনীয় টক্সিন বের করতে সাহায্য করে। তাই আমাদের উচিত রমজানের প্রতিটি রোজা পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করা, যেন আমরা আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভ করতে পারি এবং জান্নাতের পথে অগ্রসর হতে পারি।
২. তারাবিহ নামাজ
রমজান মাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো তারাবিহ নামাজ। এটি রমজানের বিশেষ নফল নামাজ, যা এশার নামাজের পর ২০ রাকাত পর্যন্ত আদায় করা হয়ে থাকে। রাসুল (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় রমজানের রাতে নামাজ আদায় করবে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে" (বুখারি ও মুসলিম)।
এই নামাজ রমজানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা মসজিদে জামাতে আদায় করা হলে আরও বেশি সওয়াব লাভ হয়। তারাবিহ নামাজের মাধ্যমে কোরআনের তিলাওয়াত শোনা এবং আত্মার প্রশান্তি লাভ করা যায়। তারাবিহ নামাজ মূলত দীর্ঘ কিয়াম, রুকু ও সেজদার মাধ্যমে বান্দাকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সুযোগ দেয়।
এটি শুধু শারীরিক ইবাদত নয়, বরং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমও। রমজানের রাতগুলোতে তারাবিহ নামাজ আদায় করা হলে, আল্লাহর রহমত লাভের পাশাপাশি অসংখ্য সওয়াব অর্জন করা যায়। এটি মুসলমানদের ধৈর্যশীল ও আল্লাহভীরু হতে শেখায়।
তাই আমাদের উচিত এই মহিমান্বিত মাসে নিয়মিত তারাবিহ নামাজ আদায় করা এবং কোরআনের তিলাওয়াতের মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা। এই নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ লাভ করা সম্ভব, যা আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ বয়ে আনবে।
৩. কোরআন তিলাওয়াত
রমজান মাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো কোরআন তিলাওয়াত। এটি এমন এক মাস, যেখানে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কোরআন নাজিল করেছেন। কোরআনে বলা হয়েছে, "রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে মানুষের জন্য পথনির্দেশ এবং সঠিক দিশা ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে" (সূরা আল-বাকারা: ১৮৫)।
এই মাসে কোরআন তিলাওয়াত করলে বহুগুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়, কারণ এটি আল্লাহর বাণী এবং আমাদের জীবনের পথনির্দেশনা। রাসুল (সা.) এই মাসে কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দিতেন এবং ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) এর সঙ্গে পুরো কোরআন তিলাওয়াত করতেন (বুখারি)।
তারাবিহ নামাজেও কোরআন তিলাওয়াত হয়, যা মুসলমানদের জন্য বড় নিয়ামত। কোরআন শুধু পড়লেই হবে না, বরং তা বুঝে আমল করার চেষ্টা করা উচিত। এটি আমাদের হৃদয়কে প্রশান্তি দেয়, চিন্তাভাবনাকে পরিষ্কার করে এবং আল্লাহর রহমত লাভের পথ তৈরি করে।
তাই রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে কোরআন তিলাওয়াত করা উচিত, যেন আমরা আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে পারি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি। কোরআনের আলোতে জীবন পরিচালনা করলে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করা সম্ভব।
৪. দান-সদকা করা
রমজান মাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো দান-সদকা করা। এটি এমন একটি সওয়াবের কাজ, যা মানুষকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। রাসুল (সা.) বলেছেন, "রমজানে দান-সদকা করার সওয়াব অন্যান্য সময়ের তুলনায় বহুগুণ বেশি" (তিরমিজি)।
রমজান সংযমের মাস, আর এই মাসে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সাহায্য করা আমাদের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। দান-সদকা মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা তৈরি করে এবং পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। রাসুল (সা.) ছিলেন দানশীলতার সর্বোত্তম উদাহরণ।
ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, "রাসুল (সা.) ছিলেন সর্বদা দানশীল, তবে রমজানে তিনি প্রচণ্ড দানশীলতা প্রকাশ করতেন" (বুখারি)। এই মাসে দান করলে পাপ মোচন হয় এবং জান্নাতের পথে এগিয়ে যাওয়া যায়। যাকাত, ফিতরা, সাধারণ সদকা কিংবা গরিবদের ইফতার করানো সবই দানের অংশ, যা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন।
আল্লাহ বলেন, "যারা আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ হলো একটি শস্যবীজের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ গজায় এবং প্রতিটি শীষে থাকে একশত করে শস্য" (সূরা আল-বাকারা: ২৬১)। তাই আমাদের উচিত রমজানের বরকতময় মুহূর্তগুলো কাজে লাগিয়ে বেশি বেশি দান-সদকা করা, যাতে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত লাভ করা যায়।
৫. ইফতার করানো
রমজান মাসে একটি অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আমল হলো ইফতার করানো। রোজাদারদের ইফতার করানো, বিশেষত দরিদ্র ও অসহায়দের ইফতারি দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সাহায্য করা, বড় সওয়াবের কাজ।
রাসুল (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে ইফতার করায়, তার জন্য সেই রোজাদারের সওয়াবের মতো সওয়াব লেখা হয়, অথচ তার সওয়াবে কোন কমতি হয় না" (তিরমিজি)। এটি এমন একটি আমল, যা মানুষের মধ্যে সহানুভূতি ও সামাজিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করে।
যখন মানুষ ইফতারি গ্রহণ করে, তাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, এবং সেই সঙ্গে তাদের প্রতি আল্লাহর রহমত ও বরকত বৃদ্ধি পায়। ইফতার করানোর মাধ্যমে রোজাদারদের দুঃখ-দুর্দশা বুঝতে পারা যায়, এবং আল্লাহর কাছে তাদের জন্য দোয়া করা যায়।
বিশেষ করে ফিতরা বা যাকাতের মাধ্যমে গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা, এবং তাদের সাদরে ইফতারি প্রদান, এ মাসের মহান মর্যাদার মধ্যে পড়ে। রাসুল (সা.) নিজে ইফতারি দিতেন, এবং অন্যদেরও তা করার জন্য উৎসাহিত করতেন।
তাই আমাদের উচিত, রমজান মাসে যতটুকু সম্ভব গরিবদের ইফতারি দিতে চেষ্টা করা, যাতে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি এবং সমাজে ভালোবাসা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
FAQ
১. রমজান কেন গুরুত্বপূর্ণ?
রমজান আত্মসংযম, ইবাদত ও কোরআন নাজিলের মাস, যা মুসলমানদের জন্য বিশেষ ফজিলতপূর্ণ।
২. রমজানের সেরা ইবাদত কী?
রোজা, নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা ও দোয়া করা।
৩. লাইলাতুল কদর কোন রাতে হয়?
রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে লাইলাতুল কদর রয়েছে।
৪. রোজা রাখার শর্ত কী?
প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মুসলমানদের জন্য রোজা রাখা ফরজ। অসুস্থ ও ভ্রমণরত ব্যক্তিরা পরে কাযা করতে পারেন।
৫. কি কারণে রোজা ভেঙে যায়?
খাওয়া-দাওয়া, পান করা, ইচ্ছাকৃত বমি, মাসিক শুরু হওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে রোজা ভেঙে যায়।
৬. ইফতার ও সেহরির গুরুত্ব কী?
ইফতার দ্রুত করা ও সেহরি দেরিতে করা সুন্নত এবং এতে বরকত রয়েছে।
৭. রমজানে শয়তানকে কীভাবে শৃঙ্খলিত করা হয়?
আল্লাহর রহমতে এই মাসে শয়তানদের প্রভাব কমে যায়, ফলে মুসলমানরা বেশি ইবাদত করতে পারেন।
৮. রমজানে দান-সদকা করার ফজিলত কী?
এই মাসে দান করলে সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং গরীবদের সহায়তা করা হয়।
৯. মহিলারা কি রমজানে নামাজ ও কোরআন পড়তে পারেন?
মাসিক ব্যতীত সময়ে মহিলারা নামাজ ও কোরআন পড়তে পারেন।
১০. রমজান মাসে কি সব ধরনের গুনাহ মাফ হয়?
আল্লাহ তওবাকারীদের সব গুনাহ মাফ করেন, যদি তারা সত্যিকারভাবে অনুতপ্ত হয়।